শিল্পী শাহনুর মামুনের জলাঙ্গন

কামালুদ্দিন

যদিও আমি হস্তরেখাবিদ বা জোতিষী নই তবুও বলেছিলাম, তুই জলরঙ ছাড়া আর কোন মাধ্যমে ছবি আঁকবি না। তোর হাতটি জলরঙের জন্য বরাদ্দ করেছে খোদ বিধাতা। হাতের গতিবিধি জলরঙে সাবলিল আতœপ্রকাশ দেখে ওর ছাত্রজীবনেই বলেছিলাম এ কথা। খুব কাছ থেকে দেখেছি শিল্পী শাহানুর মামুনকে। ¯েœহের উঞতা দিয়ে অনুভব করেছি তাকে।

নিরবচ্ছিন্ন চর্চায় তার একেকটি ছবি কীভাবে স্বছন্দে শিল্পোত্তীর্ণ হয়ে উঠছে সব কিছুরই প্রত্যক্ষ স্বাক্ষী আমি। শাহনেওয়াজ ভবনে আমার পাশের রুমে থাকতো সে। একদিন ডেকে অনেকগুলো হ্যান্ডমেইড পেপার আর জলরঙ দিয়ে বলছিলাম, এগুলো নে। বেশী করে জলরঙের ছবি আঁকবি আর আমাকে দেখাবি। মামুন অগ্রজের ¯েœহোষ্ণ দাবিকে অভ্যর্থনা জানালো সহাস্য ও বিনীত ভঙ্গিতে। বলেছিল, জ্বি, জ্বি কামাল ভাই, অনেকগুলো ছবি এঁকে আপনাকে দেখাবো। তার সে দিনের মুখ আমার এখনো মনে আছে। যেন ভুখা একজন মানুষ অনেকদিন পর খাবার পেয়েছে। সত্যিকার্থে যার ভেতরে ছবি আঁকার ক্ষুধা থাকবে সেইতো শিল্পী হবে। আমার মনে হয় না সেই ছাত্রজীবন থেকে শিল্পী শাহনুর মামুন এখনো অবধি একদিনের জন্যও জলরঙের ছবি আঁকা বন্ধ করেছে। এমন একটা দিন ছিল না , দেখা হলে সে তার জল রঙের সঙ্গে দিনযাপনের মুর্হূগুলি রোমান্থন করেনি। তার জীবনের সবটাজুড়ে ছড়িয়ে আছে জলরঙ। তার আচার-আচরনেও জলরঙের ¯্রােত আছে, প্রবাহ আছে, গতি-প্রকৃতি আছে। একটা কথা বললে অতিশয়োক্তি হবে না ছবি না আঁকলেও সে খালি চোখে প্রকৃতি, মানুষ যা-ই দেখুক না কেন সর্বত্র স্বচ্ছ জলরঙের জীবন্ত চিত্রপরিসর দেখতে পায়।

আমাদের দেশে সাধারণত কেবল একটা মাধ্যমকে কেন্দ্র করে শিল্পী গড়ে উঠেননি। একমাত্র শাহনুর মামুনই জলরঙকে ছবি আঁকার একমাত্র মাধ্যম হিসেবে চিত্রান্তর্গত করেছেন। শাস্ত্রে আছে ভারতবর্ষের আলো তেলরঙের জন্য নয়। তাই সে বুঝে গেছে ভাটির দেশের জলাঙ্গন।এমনকি সদ্য ভূমিষ্ট হওয়া নিজের দ্বিতীয় পুত্র সন্তানের নামও রাখলো ‘জল’ । কী অসামান্য বিষয় না! সে জল শব্দের সাথে এতটাই আতিœক আর নিবিষ্ট যে, তার ছবিযাপনে যে সুর-ছন্দের মহিমা বিম্বিত হয়ে আছে তাতে কেবলই জলের শব্দই যেন পাওয়া যায়। ছবিভীরু এই শিল্পী তুলির অনুরণনে যে সৌকুমার্য ব্যাপৃত করেছেন তার সর্বত্রই প্রকৃতিদেবীর গুনকীর্তনে ভরপুর। তাঁর চিত্রনে প্রকাশ পেয়েছে প্রকৃতির প্রতি অসীম কৃতজ্ঞতা।

মামুন মূলত রঙনির্ভর ছবি আঁকেন। সাধারণত মানুষ অপটিক্যালি বস্তুর রঙ দেখে, তারপর গড়ন। তার ছবিতে জল আর রঙের টলমলে প্লাবন আছে, যে প্লাবন সমস্ত চিত্রভূমি ডুবিয়ে দিয়েছে। তার ছোট-বড় তুলিগুলো প্লাবনে স্বচ্ছন্দে ভেসে বেড়ায়। তার ছবিতে অভব্যতার লেশমাত্র নেই; আছে শুধু রঙে প্রাণসঞ্চার বা প্রাণে রঙসঞ্চার। এসব ছবিতে আছে দেশাতœবোধ, জাতিচেতনা, মা, মাটি, বিশ্বপ্রকৃতি প্রভৃতি।

উল্লেখ করা ভালো, শিল্পী মামুন ইম্প্রেশনিস্ট শিল্পী দ্বারা প্রভাবিত। যেমন- ছবির রঙ, আলো, তাৎক্ষণিক সময়কে ধরা, লুজ ব্রাসিং, আউটডোরে ছবি আঁকা প্রভৃতিতে সে ঘরানা স্পষ্ট। তাকে প্রায়শ দেখা যায় ঢাকার জং ধরা বিমর্ষ আলো সরিয়ে দিয়ে বাইরে যেতে-রৌদ্রকরোজ্জল ছবি আঁকার জন্য। যেমনটি ভ্যানঘগ করেছিলেন। প্যারিস ত্যাগ করে আলোর সন্ধানে গিয়েছিলেন আর্লের মত মফস্বল শহরে।

আরেকটি বিশেষভাবে লক্ষনীয়, মামুনের ছবিতে উষ্ণরঙের প্রাবল্য বেশী। যেমন-হলুদ, লাল, কমলা এসব উত্তেজক রঙের সরাসরি ব্যবহার শিল্পীদের হাতে সাধারণত এতটা নিয়ন্ত্রন থাকে না। এই দেদীপ্যমান রঙগুলোর ব্যবহার, চিত্রভূমির উপর তুলির কর্ষণ, নির্ভীকভাবে রঙ গড়িয়ে দেওয়া, ছড়িয়ে দেওয়া, একটার পর একটা নিরন্তন ছবি এঁকে যাওয়া, সবই তার সহজাত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। চীন জাপানের শিল্পীদের মতে জলরঙ হচ্ছে যাদুকরী রঙ। আমাদের মতে জলরঙ হচ্ছে কবিতার মতো, অনেকটা অসম্পূর্ণ কথা বাকিটুকু বুঝে নিতে হয়। অকথিত বাক্যগুলো বুঝে নিতে হয় প্রজ্ঞা দিয়ে তেমনি মামুনের ছবিও বুঝতে হবে কবিতা পড়ার অভিজ্ঞতা দিয়ে। ওর ছবিতে প্রকৃতির বা বিষয়ের অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ বা অতিকথন নেই। শুধু রঙ, জল, উপমা, প্রতিকী বাক্যে ঠাসা কবিতার মতো বুঝে নেওয়ার ব্যাপার আছে। কারণ শিল্প হচ্ছে মামুনের কাছে একটা মায়া। সে মায়ায় ডুব দিয়ে চিত্রের গহীনে যাওয়ার জন্য নিরবচ্ছিন্ন চেষ্টা করে যাচ্ছে সে। ছবি আঁকার পুরো উম্মাদনা তাকে সব সময় তাড়িত করছে। তার গতিশীল তুলিতে প্রত্যয়ের সুর ধ্বনিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। যেহেতু চিত্রকলায় অবগাহন তার একমাত্র ব্রত, শিল্পের পূজক হয়ে শিল্পিত জগৎ সৃষ্টি করাই তার একমাত্র স্বপ্ন, তাই তার মননে, চিন্তনে সর্বদা শিল্পসৃষ্টির অনুধ্যান বিদ্যমান।