তরল আলোর স্নিগ্ধতা
মইনুদ্দীন খালেদ
সব দিকেই জল। আকাশে জলটুম্বুর মেঘ। ভূমিতে কলোলিত শত নদী। প্রকৃতি ঘনসবুজ; নিরন্তর পলবিত। স্বদেশ বাংলাদেশ ভূগোলের হিসেবে খুব বড় নয়, কিন্তু প্রাকৃতিক আয়োজন ও আনুষ্ঠানিকতায় তা বিপুল ও বিচিত্র। এখানে সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা-রাত কাজে সরব ও ধ্যানে মৌন। আহ্নিক গতির লীলাকে বদলে দেয় বার্ষিক গতি; ষড়ঋতুর আবর্তে বর্ণিকাভঙ্গের অপার রহস্য পাঠ করে আমাদের আকুল চোখ। ওই ব্যাকুলতায় কোনো কিছুই আর স্থির নয়। মন কেবলই অনুভব করে আলোর বিচিত্র লহরী; চোখ পাঠ করে নির্দিষ্ট রূপ নয় বরং রূপান্তরের রসায়ন। এই সরসতা ও সজীবতার নৈসর্গিক যজ্ঞে চোখ রেখে শিল্পী হতে চেয়েছেন শাহানূর মামুন। তার নবীন চোখের মণি আর মস্তিষ্কের সতেজ কোষ স্বদেশ বাংলার ওই রং-রূপের প্রবহমানতার রহস্যের অন্তর্বয়ন বোঝার জন্য শিল্পযাত্রা শুরু করেছে।
শাহানূর অনুমেয়কে আঁকতে চেয়েছেন। চোখের দেখাটা অনেকাংশে অগ্রাহ্য করেছেন। অনুভূতিলোক উপচে দিতে চাইলে রেখার চেয়ে রং বেশি প্রণোদনা দেয়। এই নবীন শিল্পীর কাজ দেখে মনে হয় জলপুষ্ট মেঘ যেন আর ভার বইতে পারছে না; আবার অন্যদিকে মনে হয় প্রকৃতি ও মানুষের চেনা রূপগুলোও বর্ণের স্বরলিপিতে কথা বলতে চায়। অনেক তরল আলো আর অনেক সুচিক্কন মেঘমালার দোলায় সৃজনের হর্ষ অনুভব করেছেন এই নবীন।
ইংরেজ ও ওলন্দাজের জলরংয়ের অভিজ্ঞতা আর প্রাচ্যের ছবি ই¤েপ্রশনিস্টদের শিল্পভাবনা দানা বাঁধতে সহায়তা দিয়েছিল। এক পর্যায়ে গিয়ে এই সত্য উদ্ভাবিত হয়ে পড়ল যে বর্ণই আসলে ঈশ্বর। সেই থেকে চিত্রতলে বর্ণ স্বয়ম্ভূ। বর্ণেই প্রকৃতির স্বয়ংপ্রকাশ বিচিত্র গতায়ত। শাহানূর মামুন এবং আরও কারও কারও কাজ দেখে আমার মনে হয়েছে যে রংয়ের ওই স্বয়ংচাল তারা তুলিত করতে পেয়েছেন বিশেষ পারমিতার জোরে। দীর্ঘ অনুশীলন ও পরিশীলনের প্রয়োজনটা তারা উপক্ষো করেননি। শিল্পের যে কোনো রীতি বা ভাষা ভিন্ন ভূগোলে ভিন্ন ভাষা পায়। রং দিয়ে জগৎ-সংসারের পরমার্থকে বুঝতে গিয়ে এদেশের গুরুশিল্পী থেকে শুরু করে পরবর্তী প্রজন্মের শিল্পীরা শিল্পে যে স্বকীয়তার মাত্রা যোগ করেছেন তাতে ই¤েপ্রশনিস্ট শিল্পভাষার নতুন রূপ ফুটেছে। এ সাধনা প্রধানত হয়েছে জলরংয়ে। বাংলাদেশের শিল্পচর্চায় জল রংয়ের যে পরম্পরা বা ঐতিহ্য সৃষ্টি হয়েছে তারই পথ শাহানূরের মত নবীনদের সাহস ও উৎসাহ যুগিয়েছে। নবীন প্রাণ যখন রং নিয়ে শিল্পখেলায় মগ্ন হয় তখন তাতে স্বল্পময়তার অভিঘাত স্পষ্টত চোখে পড়ে। এই পৃথিবী আলো-অন্ধকারের নাটক। অনেক রংয়ের আলো আর বিচিত্র অন্ধকারের বুনটে দৃশ্যমান এই পৃথিবী। এর রহস্যভেদই সৃজনশীলতার অন্যতম অন্বিষ্ট। কিন্তু চোখের দেখাকে মনের ভাবনার সঙ্গে সমীকরণ টানতে হয়। শিল্পে মন কেবলই প্রবিষ্ট হতে থাকে। শাহানূর যেন এই শিক্ষার্থী জীবনের শেষ লগ্নে এসে জেনে গেছেন সৃষ্টিতে আত্মা স্ফূটিত হয়। মনের স্বয়ংপ্রকাশ ছাড়া শিল্প শিল্পোত্তীর্ণ হয় না। তার চিত্রতলে বর্ণের সঞ্চরনশীলতা ও বর্ণের মেঘায়নের মত পরিচর্যা যা প্রায় বিমূর্তকে বা অরূপকে স্পর্শ করে যায় তা আমাদের সম্মোহিত করে রাখে।
শিল্পের মুদ্রা সংগ্রহের জন্যে দূরাতীত কাল থেকে শিল্পীরা প্রকৃতির পাঠশালায় বসে আছেন। আমরা নদীকূলে বাস করি, প্রধানত নদী আমাদের দীক্ষাগুরু হলেও পাহাড় ও সমুদ্রও আমাদের শিক্ষা দেয়। পাহাড় জানায় অচলের মহিমা স্থানুর ভার। সমুদ্র তরঙ্গাভিঘাতে জানিয়ে যায় এ পৃথিবীর তিনভাগই জল। সেই নিয়ম মেনে শাহানূর সমতলের প্রকৃতি ও পাহাড়ি প্রকৃতি দুই-ই দেখেছেন। প্রকৃতি যেখানে আশৈশবের চেনা প্রকৃতি নয়, ভিন্ন রকমের, তখন তা মনে বিশেষ দোলা নিয়ে আসে। পার্বত্য স্বদেশ দেখে শাহানূর অভিভূত হয়েছেন। এখানে এসে তিনি বুঝেছেন সমতলে দাঁড়িয়ে থাকা আর পাহাড়ের কোলে দাঁড়িয়ে দেখা কখনোই এক হতে পারে না। পরিপ্রেক্ষিতের ভিন্নতায় যে নতুন নিসর্গ অবলোকন তারও সরস উপস্থাপনা আছে এই শিক্ষার্থী-শিল্পীর কাজে। আমরা দেখেছি যে সমতলের প্রকৃতি দেখায় অভিজ্ঞ শিল্পসন্ধানী মানুষেরা পাহাড় দেখে এক নিবিড় বিমুগ্ধতায় অভূতপূর্বকে শিল্পে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেন। শিক্ষাজীবনে প্রায় সব শিক্ষার্থীই অনুশীলনের প্রয়োজনে পাহাড় ও সমুদ্র দর্শনে যান। পরবর্তী সময়ে এদের মধ্যে যারা শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন তাদের সবারই অনুশীলন পর্বের কাজ বিশেষ মানে যে উত্তীর্ণ হয়েছিল তা আজও বোঝা যায়। আমার মনে হয়, শাহানূর শিল্পসাধনার কঠিন ব্রতে একনিষ্ঠ থেকে সেই সত্যকে প্রমাণিত করতে পারবেন।
কিন্তু বস্তুভার নয়, প্রধানত তরল আলোর অভিব্যক্তিকে নিবিষ্ট হয়ে আছেন শাহানূর। মেঘমালা আর সূর্যের আলোয় যে প্রিজম তৈরি হয় তার অবাক-করা আলোকে তিনি বর্ণময়তায় ধরতে চেয়েছেন। আবার জলটুম্বুর মেঘভারের শিহরণটুকুও তার কাম্য। আসলে মেঘের উদগীরণ, জলের উচ্ছ¡াস আর সংক্ষিপ্ত ভূমিকে রেখে এই নবীনের যে কাজ তাতে প্রমান্য প্রকৃতির চেয়ে প্রকৃতির অন্তর্নিহিত বিন্যাস ও বিভিন্ন অনুষঙ্গের পারস্পরিক সন্নিকর্ষকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। আর নগরদৃশ্যেও রূঢ় রেখার জ্যামিতি প্রাধান্য পায়নি তার অভিনিবেশে। বরং নগরেও জলের প্রতিক্রিয়া তিনি বুঝতে চেয়েছেন দালানকোঠা, যানবাহন, সড়ক ও গলি-গুপচি এঁকে। বৃষ্টিমুখর অথবা বৃষ্টিস্নাত নগরকে শাহানূর প্রাধান্য দিয়েছেন, আর অন্তর্ভেদী হওয়ার প্রবণতাকে তৃপ্ত করেছেন পরিপ্রেক্ষিতের বিলীয়মানতাকে দালানসারির ভেতর দিয়ে দেখে। তবে দ্বিমাত্রিকতাও তরল আলোর পরিচর্যার প্রকৃতিদৃশ্যের বিপরীতে যাত্রা তার নগরদৃশ্য। এখানে ত্রিমাত্রিকতা ও মনোক্রমিক পরিচর্যার কারণে শাহানূরের ড্রইংয়ের ক্ষমতা পরীক্ষিত হয়েছে বিশেষ স্পষ্টতায়। দালানকোঠা, মানুষ, যানবাহন প্রামাণিক স্পষ্টতায় উপস্থাপিত হয়নি তার কাজে। রৈখিক পরিমার্জনা আর বর্ণঝোপে সবকিছুর মধ্যে যাপিত সময় ও জীবনের পুরাকীর্তি সংকীর্তিত রয়েছে। প্রাধান্য পেয়েছে কাব্যময়তা ও স্মৃতির বিধুরতা। ছবির পাশাপাশি সিরামিক্স মাধ্যমের কাজও উপস্থাপন করেছেন শিল্পী। আধা-বিমূর্ত গড়নের নির্ভরতায় প্রকৃতি ও মানুষী গড়ন এবং মানব-সম্পর্কের স্বরূপ অন্বেষণ করেছেন শিল্পী। বস্তুভার ও নির্ভরতা রূপ ও অরূপের টানা-পোড়েনের পরীক্ষায় মনোনিবেশ করেছেন শাহানূর। চেনা অবয়বের অনুকরণে এই তরুণ বিশ্বাসী নন। বিমূর্ততার শর্তে অভিব্যক্তির মাহাত্ম্য অনুধাবনের কঠিন পথ তিনি পরিক্রমণের অঙ্গীকার করেছেন; তার কাজের দিকে তাকালে এ সত্যকে অনুভব করা যায়।
মইনুদ্দীন খালেদ
২১ জুন ২০১৩